ইসলামী জীবনদর্শন ও নৈতিকতার অমূল্য উৎস হাদিসে মানবজীবনের প্রতিটি দিককে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের সৃষ্টি, স্বভাব, নৈতিকতা, রাষ্ট্রনীতি, সমাজজীবন এসব বিষয় হাদিসে গভীরভাবে আলোচিত হয়েছে। সম্প্রতি ইয়ায ইবনু হিমার আল মুজাশি’ঈ (রা.) থেকে বর্ণিত এক দীর্ঘ ও শিক্ষামূলক হাদিস মানবসমাজের জন্য আদর্শ ও বিপথগমনের স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরেছে।
হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আমার প্রতিপালক আমাকে এমন জ্ঞান প্রদান করেছেন যা তোমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।” এই জ্ঞান মানুষের জন্মগত ফিতরাহ, শয়তানের প্ররোচনা, আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীদের দায়িত্ব, ন্যায়পরায়ণ শাসক ও কোমল-হৃদয় মানুষের মর্যাদা, এবং বিভিন্ন ধরনের গুনাহগারের পরিণতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা সব মানুষের মনকে পবিত্রভাবে সৃষ্টি করেছেন। তবে শয়তান মানুষের নিকট এসে তাদেরকে দীন থেকে সরিয়ে নেয়, যা বৈধ ছিল তা হারাম করে প্রদর্শন করে এবং মানুষকে আল্লাহর অজানা কোনো বিষয়ে তাঁকে অংশীদার করতে প্ররোচিত করে। এটি মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করার এক সুক্ষ্ম প্রক্রিয়া।
হাদিসে আরও উল্লেখ আছে, আল্লাহ পৃথিবীবাসীর দিকে দৃষ্টি দিয়ে আরব ও আজম (অযারব মানুষ) ছাড়া কিতাবীদের কিছু অংশকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। তবে কিতাবীদের মধ্যে যে অংশ আল্লাহর নির্দেশ অনুসরণ করে তারা মানব সমাজের জন্য নৈতিক ও আদর্শিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেকে মানবসমাজের পরীক্ষায় প্রেরণকৃত হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং তার মাধ্যমে অন্যদেরও পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে। তিনি বলেন, “আমি এমন কিতাবের মাধ্যমে প্রেরিত হয়েছি যা পানি দ্বারা ধুয়ে-মুছে ফেলা যাবে না; এটি মানুষের ঘুম-জাগরণে পাঠযোগ্য।”
হাদিসে কুরাইশ সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে, আল্লাহ রাসুলকে নির্দেশ দিয়েছেন, তাদেরকে উপযুক্ত প্রতিদান দিতে। “যেমন তারা তোমাকে বের করেছে, তেমনি তুমি তাদেরকে বহিষ্কার করো এবং তাদের সঙ্গে লড়াই করো। যারা তোমার আনুগত্য করবে তাদের সাথে থাকো, যারা বিরোধিতা করবে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নাও। আমি তোমাকে সাহায্য করব।”
রসূলুল্লাহ (সা.) জাহান্নাত ও জান্নাতের বর্ণনা দিয়ে মানবিক গুণাবলীর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, তিন শ্রেণির মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করবে:
১. ন্যায়পরায়ণ শাসক, যিনি ক্ষমতাধর হলেও সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় অটল।
২. দয়ালু ও কোমলচিত্ত মানুষ, যিনি আত্মীয়স্বজন এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি সদয়।
৩. পরিপূর্ণ সতর্ক ও শৃঙ্খলাবদ্ধ মানুষ, যিনি সততা ও পরিশীলিত জীবনযাপনে অনন্য।
অপরদিকে পাঁচ ধরনের মানুষ জাহান্নামে যাবে:
১. দুর্বল ও অনীহ মানুষ, যারা কোনো নৈতিক বা সামাজিক দায়বোধ রাখে না।
২. খিয়ানতকারী, যাদের লোভ ও প্রতারণা প্রকাশ্য ও গোপন উভয়ভাবে প্রয়োগ হয়।
৩. যারা পারিবারিক ও সামাজিক সম্পদ নিয়ে প্রতারণা করে।
৪. কৃপণতা ও মিথ্যা বলার অভ্যাসসম্পন্ন।
৫. অশ্লীল ভাষা ব্যবহারকারী ও অনৈতিক আচরণসম্পন্ন।
এই হাদিসের মাধ্যমে মানুষের জীবনে সৎ জীবনযাপনের, ন্যায় ও সদাচারের গুরুত্ব, শয়তানের প্ররোচনা থেকে সাবধান থাকার এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করার গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় দিক নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষারও এক চমৎকার দৃষ্টান্ত।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী মানুষের নৈতিক ও সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত হয়। যে ব্যক্তি সত্য, ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু হবে, সে জান্নাতের অধিকারী; অন্যদিকে যারা প্রতারণা, কৃপণতা ও অনৈতিকতার পথ অনুসরণ করবে, তাদের কঠোর ফলাফল ভোগ করতে হবে।
এই হাদিসটি মানব সমাজের জন্য এক পূর্ণাঙ্গ চিত্রপট প্রদান করেছে মানুষ কোন পথে চলবে তা স্পষ্ট, এবং কোন পথ বিপথগামী। এটি নতুন প্রজন্মকে নৈতিক ও সামাজিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে, যা ব্যক্তি ও সমাজের কল্যাণ নিশ্চিত করতে সহায়ক।
সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের জন্য হাদিসের শিক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে নৈতিকতা ও সততার বিকল্প নেই, এবং শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্ত থাকতে হলে আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলা অপরিহার্য।
এই হাদিসের শিক্ষা আমাদের দেখায় যে, মানব জীবনে ন্যায়, দয়া ও সততার চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। প্রতিটি মুসলিমের জীবনে এই শিক্ষা মেনে চলাই জীবনের সাফল্য ও আখিরাতের নিরাপত্তার চাবিকাঠি।
Leave a Reply